
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে সিলেট–তামাবিল সড়ক ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সেনা চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাকিস্তানি সেনারা গোয়াইনঘাটের রাধানগর গ্রামে গড়ে তোলে শক্তিশালী সামরিক ক্যাম্প। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তারা আশপাশের এলাকায় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন চালিয়ে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি করে।
এক মাসের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে পাকিস্তানি ঘাঁটি ঘেরাও করে আক্রমণ শুরু করেন। দক্ষিণ পাশটি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে খোলা রাখেন যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য পলায়নের পথ থাকে। পরবর্তী কয়েক দিন আক্রমণ–পাল্টা আক্রমণে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
২৬ নভেম্বর ভারতীয় গুর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ চালালেও তেমন সফলতা মেলেনি। ওই যুদ্ধে ৭১ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলে কিছুটা প্রভাব ফেলে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় regroup হয়ে ২৮ নভেম্বর আবার আক্রমণে যায়। এই লড়াইয়ের শুরুতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি নুরুল হক (বীর উত্তম) শহীদ হন।
এরপর যুদ্ধ গড়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে। গবেষক হাসান মোরশেদের সংগ্রহ করা প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য অনুযায়ী, কোনো বাহ্যিক সহায়তা ছাড়াই টানা ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে দেন। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাত ১০টার দিকে তাদের শেষ মরিয়া আক্রমণও ব্যর্থ হয়। অবশেষে মধ্যরাতে তারা গোয়াইনঘাটের দিকে পিছু হটে।
৩০ নভেম্বর সকালে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর হাইস্কুল মাঠে জড়ো হয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন চারদিক। রাধানগরের এই বিজয় সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নতুন গতি আনে—মুক্তিযোদ্ধারা এই বিজয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে আশপাশের আরও অঞ্চল মুক্ত করতে আক্রমণ জোরদার করেন।
গবেষক হাসান মোরশেদের মতে, রাধানগরে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় মুক্তিযুদ্ধের সিলেট অধ্যায়ে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল দৃঢ় করে সামনে এগিয়ে যেতে।