ঢাকা | বঙ্গাব্দ

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় ভারতে মুসলিমদের ধরপাকড়, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 21, 2025 ইং
‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় ভারতে মুসলিমদের ধরপাকড়, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ছবির ক্যাপশন: ‘আই-লাভ-মুহাম্মদ’-বলায়-ভারতে-মুসলিমদের-ধরপাকড়,-বাড়িঘর-থেকে-উচ্ছেদ
ad728

ভারতের উত্তর প্রদেশের শিল্পনগরী কানপুরের মুসলিম অধ্যুষিত সাঈদ নগরে গত ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা একটি আলোকসজ্জিত সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। এতে লাল রঙের একটি হৃদয়চিহ্নও ছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জন্মদিন উপলক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপনকে ঘিরেই এ সাজসজ্জা করা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমরা সাধারণত মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ধর্মীয় সমাবেশ, কোরআন তিলাওয়াত, মহানবীর জীবন ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা এবং শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকেন। তবে কানপুরে এর আগে এমন আলোকিত সাইনবোর্ড টাঙানোর নজির পাওয়া যায়নি।

সাইনবোর্ডটি জ্বলে উঠতেই স্থানীয় কয়েকজন হিন্দু ব্যক্তি আপত্তি তোলেন। তাঁরা পুলিশ ডাকেন, এবং কয়েক ঘণ্টা বিশৃঙ্খলার পর রাতেই সাইনবোর্ডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ধর্মীয় বিভাজন ও অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে নয়জন মুসলিম পুরুষ ও অজ্ঞাত ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়, যদিও এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

স্থানীয় হিন্দু সংগঠন শ্রী রামনবমী সমিতির সঙ্গে যুক্ত মোহিত বাজপায়ী বলেন, লেখা নিয়ে নয়, সাইনবোর্ডের অবস্থান নিয়েই আপত্তি ছিল তাঁদের। কারণ, সেটি এমন স্থানে লাগানো হয়েছিল যেখানে হিন্দুরা প্রতিবছর রামনবমীর সাজসজ্জা করে থাকেন। তাঁর দাবি, “সব ধর্মের সমান অধিকার আছে, কিন্তু নতুন জায়গায় নতুন প্রথা চালু করা ঠিক নয়।”

মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানিয়েছে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ প্রচারণাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে অন্তত ২২টি এফআইআর হয়েছে, যেখানে আড়াই হাজারের বেশি মানুষের নাম উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে বেরেলি শহরে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সাঈদ নগরের মুসলিমরা বলছেন, সাইনবোর্ডটি এমন এক উন্মুক্ত জায়গায় ছিল, যেখানে তাঁরা প্রতি বছর মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপন করেন। তাঁদের দাবি, এ বছরও সরকারের অনুমতি নিয়ে তাঁরা আয়োজন করেছিলেন। একজন তরুণ বাসিন্দা বলেন, “সংবিধান আমাদের ধর্ম পালন করার অধিকার দিয়েছে।” তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি, কারণ তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।

অভিযুক্তদের আইনজীবী এম এ খান জানান, মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তাঁরা ৫ সেপ্টেম্বরের শোভাযাত্রায় হিন্দুদের ব্যানার ছিঁড়েছেন। কিন্তু যাঁদের নাম মামলা করা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই ওই শোভাযাত্রায় ছিলেন না।

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া

উত্তর প্রদেশে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মুসলিমের বসবাস, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। ২০১৭ সাল থেকে রাজ্যটি শাসন করছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথ—নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির প্রভাবশালী নেতা, যিনি মুসলিমবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত।

কানপুরের ঘটনার কয়েক দিন পর তার প্রভাব পড়ে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরের শহর বেরেলিতে, যা বেরলভি সুন্নি মুসলিমদের প্রধান ঘাঁটি। রাজ্য পুলিশ সেখানে ৯ সেপ্টেম্বর একজন ধর্মীয় নেতা ও আরও আটজন মুসলমানের বিরুদ্ধে এফআইআর করে—ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট ও নতুন প্রথা চালুর অভিযোগে।

ইত্তেহাদ-ই-মিল্লাত কাউন্সিল (আইএমসি)-এর প্রধান ও বেরলভি নেতা মাওলানা তৌকির রেজা খান ২১ সেপ্টেম্বর কানপুর ও বেরেলির ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দেন। প্রশাসন অনুমতি না দিলেও, ২৬ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের পর হাজারো মুসলমান ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা পোস্টার হাতে বেরেলির একটি মাজার এলাকায় জড়ো হন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লাঠিচার্জ হয়, সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে এবং মাওলানা তৌকিরসহ বহু মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। শহরে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তৌকির রেজা খান ভিডিওবার্তায় বলেন, “ধর্মীয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের জন্যই এ অভিযান।” তিনি সতর্ক করে দেন, “আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি দমন ভালো ফল বয়ে আনবে না।”

এরপর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বেরেলির ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “কখনো কখনো কঠোর হতে হয়, যেমন বেরেলিতে দেখা গেছে। একজন মাওলানা ভুলে গেছেন, কে ক্ষমতায় আছে।” তাঁর এ মন্তব্যের পর মুসলমানদের ওপর দমন–পীড়ন আরও বেড়ে যায়।

সরকারের ‘ভীতি সঞ্চারের কৌশল’

বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের বাড়ি ও দোকান উচ্ছেদ এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের ‘বুলডোজার জাস্টিস’ নিষিদ্ধ করেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ—এগুলো আইনবহির্ভূত এবং বিচারপ্রক্রিয়া এড়িয়ে মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। উত্তর প্রদেশ সরকার অবশ্য দাবি করছে, উচ্ছেদ হওয়া ভবনগুলো অবৈধ নির্মাণ ছিল।

উর্দু কবি মুনাওয়ার রানার কন্যা সুমাইয়া রানা বলেন, “বিজেপি সরকার ভয় সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় কথা বলার সাহস না পায়।” লক্ষ্ণৌতে আয়োজিত তাঁর এক বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কয়েকজনকেও অল্প সময়ের জন্য পুলিশ আটক করে।

এপিসিআরের সাধারণ সম্পাদক নাদিম খান বলেন, কর্তৃপক্ষ নবী (সা.)–এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশকে ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখছে। অনেক ক্ষেত্রে আইন মানা ছাড়াই মামলা ও উচ্ছেদ চলছে, যা মুসলিম সমাজে গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনছে।


নিউজটি পোস্ট করেছেন : Jatio Khobor

কমেন্ট বক্স
দক্ষতা উন্নয়নে নজর কম, ফ্রিল্যান্সার তৈরির হিড়িক

দক্ষতা উন্নয়নে নজর কম, ফ্রিল্যান্সার তৈরির হিড়িক