ঢাকা | বঙ্গাব্দ

চট্টগ্রাম বন্দর: আমাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি...

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 25, 2025 ইং
চট্টগ্রাম বন্দর: আমাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি... ছবির ক্যাপশন: চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি এলাকা
ad728

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালসহ (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

অবশ্য এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ডিপি ওয়ার্ল্ডকে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তখন সমালোচনা ওঠে।

বিশেষ করে এনসিটি, যে টার্মিনালটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থ ব্যয়ে (তিন হাজার কোটি টাকা) স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা হয়েছে, তা কেন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দিতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বন্দর–সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এসব মতামত উপেক্ষা করেই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এর পরিচালনা ও মাশুল আদায়ের সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকে তৎকালীন সরকার।

সেই পথে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও যাত্রা শুরু করার পর এ নিয়ে নাগরিক সমাজ ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ-পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু এসব প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে, এমনকি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ বা মতবিনিময়েরও তোয়াক্কা না করে যখন এ সরকার দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়, তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, সরকার কি কোনো আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে?

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বড় উপায় দেখছেন বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো ও এর দিগন্ত প্রসারিত করার মধ্যে। সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকবার তিনি তাঁর এই মত জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যেও এই মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

অধ্যাপক ইউনূস বন্দর বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ধারণা অবশ্য অনেক আগে থেকেই প্রকাশ করে আসছেন। মনে পড়ে, ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে চট্টগ্রামবাসীর দেওয়া এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে এক শ গুণ বড় করা দরকার এবং তা করা সম্ভব। এ বন্দরকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তাঁর সেই উদ্দীপনামূলক বক্তব্য শুনে অনেকেই তাঁকে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত ধারণাপত্র উপস্থাপন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে রকম কিছু তিনি করেননি।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই আগেভাগে মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশি অপারেটর এসে যেসব উদ্যোগ নিলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতো, তার অনেকটা আগেভাগে সরকারই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবেই হয়তো শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটাও জায়েজ করার চেষ্টা হবে। সব মিলিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার একটি অসম চুক্তির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী, শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা।

সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়ে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর দীর্ঘদিনের ধারণার বাস্তবায়ন ঘটাতে চাইবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিষয়ে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কের অবতারণা করা গেলে দেশবাসী তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশদ জানার সুযোগ পেত।

দেশের নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বাদ দিলেও বিদেশি অপারেটররা মাশুল বাড়ানো ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোর ব্যাপারে যে কতটা নির্দয়, তা পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতির পরিণতি দেখে বোঝা যায়। জিবুতি এই ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে তাদের বন্দর পরিচালনার চুক্তি বাতিল করেও এখনো ঋণের জাল থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

আরও পড়ুন

আমাদের দেশেও কিছু আলামত আমরা এরই মধ্যে দেখতে শুরু করেছি। ১৫ অক্টোবর থেকে বর্ধিত হারে মাশুল আদায় শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। একলাফে ৪১ শতাংশ বেড়েছে বন্দরের বিভিন্ন সেবার মাশুল। বছরে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করার পরও মাশুল বৃদ্ধি, তা-ও ৪১ শতাংশ, এটা ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) বন্দরের মাশুল বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে যন্ত্রপাতি, জ্বালানি, জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বাড়ানোর কথা তুলে ধরেছে। ৪০ বছরের মধ্যে ২০০৭ সালে ৫২টি সেবা খাতের মধ্যে ৫টির মাশুল বাড়ানো হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে চবক। নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, ৪০ বছর পরও কি ট্যারিফ বাড়ানো যাবে না? কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারীরা যে বলছেন, ডলারের দাম বাড়ায় মাশুল এমনিতেই ৪১ শতাংশ বেড়েছে, সেই যুক্তিকেও তো নাকচ করা যায় না।



তবে বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই আগেভাগে মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশি অপারেটর এসে যেসব উদ্যোগ নিলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতো, তার অনেকটা আগেভাগে সরকারই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবেই হয়তো শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটাও জায়েজ করার চেষ্টা হবে। সব মিলিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার একটি অসম চুক্তির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী, শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা।

এদিকে কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার চট্টগ্রাম বন্দরসংলগ্ন বারেক বিল্ডিং মোড়, নিমতলা মোড়, ৩ নম্বর জেটি কাস্টমস মোড়, সল্টগোলা ক্রসিংসহ বন্দর এলাকায় যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক, শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি এক মাসের জন্য (১১ নভেম্বর পর্যন্ত) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

এর কারণ হিসেবে কমিশনার স্বাক্ষরিত একটি গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পরিবহনের জন্য প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার যানবাহন বন্দরে চলাচল করে। এই বিপুল পরিমাণ যানবাহন চলাচলের কারণে বন্দরের ট্রাফিকব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।’

বন্দরের ট্রাফিকব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা সব সময়ের জন্যই জরুরি। কিন্তু বিশেষ এই একটি মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা নিয়ে সবার মধ্যেই কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এনসিটিসহ চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হবে। তার আগে যাতে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চায় পুলিশ।

জানি না, সরকারের দৃঢ় কিংবা একগুঁয়ে সিদ্ধান্তের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর সিঙ্গাপুরের চেয়ে বড় ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে কি না, নাকি সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের প্রতীকী গল্পটির মতো করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।


নিউজটি পোস্ট করেছেন : Jatio Khobor

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
Paris prosecutor confirms suspects arrested in Louvre heist

Paris prosecutor confirms suspects arrested in Louvre heist