ঢাকা | বঙ্গাব্দ

৪০০ প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন রাজশাহীর এই দম্পতি

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 25, 2025 ইং
৪০০ প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন রাজশাহীর এই দম্পতি ছবির ক্যাপশন: পাখি, বন্য প্রাণী ও প্রকৃতির ছবি তোলেন ইমরুল কায়েস ও উম্মে খাদিজা
ad728
পদ্মার চরে সারা বছরই থাকে পাখিদের আনাগোনা। উম্মে খাদিজা আর ইমরুল কায়েসেরও প্রিয় জায়গা এই চরাঞ্চল। অন্য অনেক আলোকচিত্রীর চেয়ে তাঁদের সুবিধাও আছে, বাসাটা রাজশাহী শহরে হওয়ায় মন চাইলেই ক্যামেরা কাঁধে চলে যান। গত বছর ১ এপ্রিলেও তা-ই করেছিলেন। বেশ কিছু পাখির ছবিও তুললেন দুজন। একটি পাখির ছবি তোলার পর নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, কী পাখি। বাসায় ফিরেই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাছে ছবি পাঠালেন। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলেন, এই পাখি বাংলাদেশে অত্যন্ত বিরল। নাম গ্রে ফ্যালারোপ বা ধূসর ফ্যালারোপ। রেড ফ্যালারোপ বা লাল ফ্যালারোপও বলে। তাঁদের আগে দেশে একবার পাখিটি দেখা গেছে। তারপর বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হলো বিরল সেই পাখির ছবি।প্রায় এক দশকে ৪২৬ প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন ইমরুল কায়েস; উম্মে খাদিজার তোলা পাখির ছবির সংখ্যাও চার শতাধিক। পাখি ছাড়া ২২ প্রজাপতির ব্যাঙ, ৩০ প্রজাতির সাপকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন তাঁরা। পাখির পর সবচেয়ে বেশি তুলেছেন প্রজাপতির ছবি। প্রজাপতিবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪২০ প্রজাতির বেশি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ইমরুল কায়েস ও উম্মে খাদিজা তুলেছেন প্রায় ৩০০ প্রজাতির ছবি। বাংলাদেশে এর আগে তালিকাভুক্ত হয়নি, এমন চার প্রজাতির ছবিও তুলেছেন এই দম্পতি। এগুলো হলো ওয়েভি ম্যাপলেট (Chersonesia intermedia), ব্রাইট বাবল ব্লু (Azanus ubaldus), অটাম লিফ (Doleschallia bisaltide) ও আনব্রোকেন সার্জেন্ট (Athyma pravara)।

ইমরুল কায়েস বলেন, ‘দেশের প্রজাপতি বিশেষজ্ঞরা আমাদের এই আবিষ্কারগুলোর জন্য অভিবাদন জানিয়েছেন। এই অক্টোবরের ১৬ তারিখও পদ্মাচরের কাশবনে লাল মুনিয়া পাখির ছবি তুলতে গিয়েছিলেন কায়েস–খাদিজা। এমন সময় বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবিরের ফোন। পদ্মায় নাকি কুমির দেখা গেছে! সঙ্গে সঙ্গে পাখির ছবি তোলা বন্ধ করে কুমিরের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন এই দম্পতি। প্রত্যক্ষদর্শী রাজু আহাম্মেদকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে থাকেন চরে চরে। কিন্তু কুমিরের খোঁজ পাওয়া কি এত সহজ! তখন ড্রোন ওড়ালেন কায়েস। প্রথমে ড্রোনটা ডান দিকে পাঠালেন। কৌতূহলী খাদিজা জানতে চাইলেন, কুমির পাওয়া গেল? কায়েস মাথা নাড়লেন, না।

একটু পরই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কায়েস, ‘পাগলি, কুমির!’

আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন খাদিজা। ড্রোন চালু অবস্থায়ই যেদিকে কুমির দেখা গেছে, সেদিকে ছুটলেন দুজন। ‘কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে জীবনে প্রথম প্রকৃতিতে সামনাসামনি কুমির দেখলাম। কায়েস ড্রোন দিয়ে কিছু ভিডিও নিল। আমি ক্যামেরায় কিছু ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম,’ এভাবেই মুহূর্তটাকে তুলে ধরলেন উম্মে খাদিজা।

বাংলাদেশে মিঠাপানির কুমিরকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন। স্বাভাবিকভাবেই কায়েস আর খাদিজার তোলা বিলুপ্ত ঘোষিত কুমিরটার ছবি আর ভিডিও নিয়ে হইচই পড়ে গেল।উত্তরবঙ্গের পর সিলেট অঞ্চলেই বেশি ছবি তুলেছেন খাদিজা-কায়েস। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানসহ সিলেটের বনাঞ্চলে তাঁদের নিয়মিত যাতায়াত। এ বছর মার্চেও গিয়েছিলেন মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড ঝরনার ওপরের পাথারিয়া রেঞ্জের বনে। সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন আলোকচিত্রী। বছরের এই সময়টায় শীতনিদ্রা ভেঙে জেগে ওঠে অনেক প্রাণী, ডানায় রং মেখে ওড়াউড়ি করে প্রজাপতিরা। ঠিক করেছিলেন পাঁচ দিন বনে বনে ঘুরে বেড়াবেন, পাখি দেখবেন, প্রজাপতি দেখবেন আর মন ভরে তাদের ছবি তুলবেন।

প্রথম দিনটা নিজেদের মতো করেই কাটাতে পেরেছিলেন। তবে দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। তা–ও শিলাবৃষ্টি। বেশির ভাগ সময় হোটেলেই বন্দী থাকতে হলো। ফেরার আগের দিন সন্ধ্যায় মনে হলো, বৃষ্টি বুঝি থেমে গেছে। নিশাচর প্রাণীদের দেখা পেতে টর্চ, হেডলাইট, ক্যামেরা নিয়ে চারজন বেরিয়ে পড়লেন। বাতাস থম মেরে আছে, চারপাশ সুনসান। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন লজ্জাবতী বানর। তারপর একটা খাটাশ, বাদুড় আর ঘুমন্ত পাহাড়ি পাখিদের দেখা পেলেন। ঠিক তখনই কালো হয়ে এল আকাশ, শুরু হলো বজ্রপাত। বিদ্যুৎ চমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল চারদিক। বনের ভেতরেই ছোট্ট একটা ছাউনিতে দৌড়ে আশ্রয় নিলেন তাঁরা। তারপর যা হলো, মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠে খাদিজার গা।

২০-২৫টি বাজ পড়ল একটানা, সঙ্গে শিলাবৃষ্টি। একেকটা শিলা টেনিস বলের সমান। ছাউনির ওপর ভেঙে পড়ল আশপাশের গাছের ডালপালা। তাঁদের ব্যাগে দুটি রেইন কভার ছিল। চারজন মিলে কোনোভাবে ওগুলোর ভেতরে নিজেদের জড়ালেন। গা ভিজে গেলেও মাথা বাঁচানোই তখন একমাত্র লক্ষ্য। বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি আর তীব্র বাতাসের তাণ্ডবের মধ্যে ছাউনির তলে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেন।

তারপর ধীরে ধীরে বৃষ্টি কমে এল। আকাশ পরিষ্কার হলো আর মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিল এক টুকরা চাঁদ। মনে হলো এই তো প্রকৃতির আসল রূপ; ভয়, সৌন্দর্য, শান্তি—সব একসঙ্গে দেখিয়ে দিল। তখন রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজে পড়েন ইমরুল কায়েস আর রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে উম্মে খাদিজা। প্রাইভেট পড়তে গিয়ে কায়েসদের দলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। স্কুলে থাকতেই ডিসকভারি চ্যানেলের পোকা কায়েস ও তাঁর বন্ধুরা। তখন থেকেই ডিজিটাল ক্যামেরা হাতে প্রকৃতি আর পাখির ছবি তুলে বেড়ান। তাঁদের দলে এবার খাদিজাও ভিড়ে গেলেন। অন্যরা ছবি তোলেন, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে এসব দেখেন খাদিজা। নিজেরও খুব ছবি তুলতে ইচ্ছা করে। বছর ঘুরতে সেই আক্ষেপও ঘুচল। কিনে ফেললেন একটা ক্যামেরা। তারপর আর পায় কে, চলতে থাকল পাখির ছবি তোলা।

২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগে ভর্তি হন ইমরুল কায়েস। উম্মে খাদিজা বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা হলেও একই শহরে থাকায় দুজনের ছবি তোলা থামে না। এরই মধ্যে তাঁদের হাতে এসেছে নতুন ক্যামেরা। বন্য প্রাণীর ছবি তোলেন এমন, আলোকচিত্রী দলের সঙ্গে রাজশাহীর বাইরেও যেতে থাকলেন। ছবি তুলতে তুলতে দুজনের মন দেওয়া-নেওয়া আর ২০২২ সালে ‘কবুল’, ‘কবুল’ বলা। খাদিজা বলেন, ‘বন্য প্রাণীর ছবি তুলতে প্রায় সময়ই দুর্গম এলাকায় যেতে হতো। পরিবার থেকে দুশ্চিন্তা করত, বাধাও দিত। বিয়ের পর সেই বাধা আর থাকল না। তখন দুজনে পরিকল্পনা করে বেরিয়ে পড়তাম।’

দুজনেরই পড়াশোনা শেষ হয়েছে এ বছর। স্নাতক শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিষয়ে এমবিএ করেছেন খাদিজা আর স্নাতকের বিষয়েই স্নাতকোত্তর করেছেন কায়েস। ২০১৯ সাল থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে উত্তরাঞ্চলে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করেন দুজন। প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করে, এমন কিছু সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত তাঁরা। এসব সংগঠনের কাজেও এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ান। নিজেদের ভালো লাগার কাজটাকেই এখন একটা বাণিজ্যিক ভিত্তি দিতে চান দুজন।


নিউজটি পোস্ট করেছেন : Jatio Khobor

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
দুই পক্ষের সংঘর্ষে উত্তপ্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নিহত একজন

দুই পক্ষের সংঘর্ষে উত্তপ্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নিহত একজন