ঢাকা | বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধের বয়ান ও ইতিহাসের দ্বন্দ্ব

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 26, 2025 ইং
মুক্তিযুদ্ধের বয়ান ও ইতিহাসের দ্বন্দ্ব ছবির ক্যাপশন: গ্রাফিকস
ad728

মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও ভুট্টোর ভণ্ডামি: হাসান ফেরদৌসের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

ইতিহাসের নিরপেক্ষ পাঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মুক্তিযুদ্ধ ছিল কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া, যার প্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বৈশ্বিক অঙ্গনে। ১৯৭১ সালের এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল, যা সে সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সরলরৈখিক নয়; এটি গড়ে উঠেছে দীর্ঘ সংগ্রাম, বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা ও নানা ব্যাখ্যার সংমিশ্রণে। এই বৈচিত্র্যের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন নতুন পাঠে সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই ধারায় হাসান ফেরদৌসের গ্রন্থ ‘ভুট্টোর তওবা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক’ এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

গ্রন্থটির দশটি প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক চালচিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে একদম নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে। পাঠক এখানে যেমন দেখতে পাবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর সহযোগী হেনরি কিসিঞ্জারের নেপথ্য ভূমিকা ও কূটনৈতিক কৌশল, তেমনি পরিচিত হবেন মার্কিন নৌ কর্মকর্তা চার্লস র‍্যাডফোর্ড ও সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের সাহসী অবস্থানের সঙ্গে—যাঁরা সত্য ও মানবতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এক অমানবিক সময়ে।

প্রথম প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তিন পরাশক্তি’–তে লেখক তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পররাষ্ট্রনীতির দ্বিচারিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও কৌশলগত সহযোগিতা বাংলাদেশের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পাকিস্তানের গণহত্যাকে উপেক্ষা করেছিল। লেখক তথ্য ও দলিলের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন—পরাশক্তিগুলোর নৈতিকতার আবরণে আসলে লুকিয়ে ছিল স্বার্থসিদ্ধির কৌশল।

‘১৯৭১: ইন্দিরা, নিক্সন ও কিসিঞ্জার’ প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নেতৃত্বের নৈতিক ব্যর্থতা—যেখানে তারা গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং অপরাধীর পক্ষ নিয়েছিল। গবেষক ভ্যান হলেনের উদ্ধৃতি টেনে লেখক দেখিয়েছেন, এটি ছিল “আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মানবিক মাত্রা অনুধাবনে চরম ব্যর্থতা।”

এরপর আসে গ্রন্থের অন্যতম আলোচিত অধ্যায় ‘একাত্তরের গণহত্যা ও ভুট্টোর তওবা’। এখানে হাসান ফেরদৌস বিশ্লেষণ করেছেন পাকিস্তানি নেতৃত্বের নৈতিক ভণ্ডামি—যেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ কোনো শাসকই গণহত্যার দায় স্বীকার করেননি, বরং কূটনৈতিক ভাষায় ‘ক্ষমা’ শব্দটি এড়িয়ে ‘দুঃখ’ বা ‘রিগ্রেট’-এর আড়ালে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ১৯৭৪ সালের নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত ‘ভুট্টোর ক্ষমাপ্রার্থনা’ ভাষণকে লেখক যথার্থভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন—যিনি একসময় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বই অস্বীকার করেছিলেন, তাঁর সেই তথাকথিত তওবা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

ভুট্টোর এই ‘তওবা’র বিশ্লেষণে লেখক উন্মোচন করেছেন পাকিস্তানি মনস্তত্ত্বের এক গভীর সত্য—যেখানে অনুশোচনার মুখোশে লুকিয়ে আছে অস্বীকার, অহংকার ও রাজনৈতিক কৌশল।

একটি জাতির কাছে তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিছক অতীত নয়, এটি তার আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। সেই ইতিহাসের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকগুলোকে নিরপেক্ষভাবে বুঝতে হাসান ফেরদৌসের এই বই একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হয়ে থাকবে।

ভুট্টোর তওবা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক
✍️ লেখক: হাসান ফেরদৌস
📘 প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
📅 প্রকাশ: নভেম্বর ২০২৪
🎨 প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
📄 পৃষ্ঠা: ১৫৯


নিউজটি পোস্ট করেছেন : Jatio Khobor

কমেন্ট বক্স
“তৃতীয় বলেই উইকেট পেলেন নাসুম।”

“তৃতীয় বলেই উইকেট পেলেন নাসুম।”