চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে তিন স্তরের সংগঠিত বাহিনী গড়ে তুলে খুন, অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী। পরিকল্পনা, হামলা ও অস্ত্রবাজির পুরো কার্যক্রম তিন ভাগে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে বিভক্ত সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিদেশে বসেই এসব নির্দেশনা দিয়ে আসছেন সাজ্জাদ।
৪ ডিসেম্বর ৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে গুলিতে অংশ নেওয়া ইফতেখার ইবনে ইসহাককে গ্রেপ্তার করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানতে পারে পুলিশ। দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে বসেই সাজ্জাদ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন নগর ও জেলার বিস্তৃত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক।
কে এই সাজ্জাদ
চালিতাতলী এলাকার ঠিকাদার আবদুল গণির ছেলে সাজ্জাদ আলী ১৯৯৯ সালে কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খান হত্যাকাণ্ডের পর অপরাধজগতে পরিচিত হন। ‘এইট মার্ডার’ নামে পরিচিত ২০০০ সালের বহদ্দারহাটের আটজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যার ঘটনাতেও তাঁর নেতৃত্বের অভিযোগ ওঠে। যদিও মামলায় তিনি খালাস পান। একই বছরের অক্টোবরে একে–৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্তি পান এবং ২০০৪ সালে দেশ ছাড়েন। এরপর থেকেই বিদেশে বসে তাঁর বাহিনী পরিচালনা করেন।
শুরুতে নুরনবী ম্যাক্সন, সরোয়ার হোসেন, আকবর আলী ও ছোট সাজ্জাদকে নিয়ে গড়ে ওঠে বাহিনী। পরে ২০১৫ সাল থেকে ছোট সাজ্জাদ নেতৃত্ব নেন।
নতুন নেতৃত্বে রায়হান–মোবারক
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বড় সাজ্জাদের বাহিনীতে অন্তত ৫০ জন শুটার ও সহযোগী রয়েছে। ছোট সাজ্জাদ কারাগারে যাওয়ার পর (১৫ মার্চ) নেতৃত্ব আসে মোহাম্মদ রায়হান ও মোবারক হোসেন ওরফে ইমনের হাতে। তাঁদের সঙ্গে আরও বেশ কিছু দক্ষ অস্ত্রধারী সদস্য যুক্ত রয়েছে।
বেপরোয়া হামলার ধারাবাহিকতা
গত বছরের ৫ আগস্ট জামিনে বেরিয়ে আসার পর বাহিনী আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২৯ মার্চ বাকলিয়ায় সরোয়ারকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হলে প্রাইভেট কারে থাকা দুজন নিহত হন। এরপর বায়েজিদ, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও রাউজানে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় বাহিনী। বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১৫ জন মারা যায় এবং বহুজন আহত হন।
৫ নভেম্বর বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর গণসংযোগে হামলায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন এবং নিহত হন সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা। এরপরও ধারাবাহিকভাবে রাউজান, অক্সিজেন, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। রায়হান ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পর ১৪টি মামলা হয়।
তিন স্তরের কাঠামো
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রায়হান–মোবারক এখন নিজেরা গুলি চালান না। তাঁরা পরিকল্পনা করেন—এরা ‘এ’ ক্যাটাগরির। ‘বি’ ক্যাটাগরির সদস্যরা খুন ও বড় হামলায় অংশ নেন আর আশপাশ পাহারা দেওয়া ও পালানোর পথ তৈরি করেন ‘সি’ ক্যাটাগরির সদস্যরা।
গ্রেপ্তার ইফতেখার জানান, কোন ঘটনায় কে কোন ক্যাটাগরিতে থাকবে, তা ঠিক করেন রায়হান ও মোবারক।
সাজ্জাদের দাবি
বিদেশ থেকে খুন–চাঁদাবাজি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে সাজ্জাদ আলী দাবি করেন, বিদেশে ব্যবসা এবং দেশে ভাড়া ঘর থেকে আয়ই তাঁর জীবিকা। তাঁর কথায়, ‘আমি কেন বাহিনী তৈরি করব? উল্টো আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।’ তিনি রায়হান বা ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার বিষয়টিও অস্বীকার করেন।
পুলিশের অবস্থান
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, বিদেশে পলাতক সাজ্জাদের তৈরি এই বাহিনী নগর ও জেলায় খুন, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজি চালায়। তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত হয়ে তারা পরিকল্পনা ও হামলা পরিচালনা করে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার হয়েছে; বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
Jatio Khobor